difference between apostille and notary

বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি কিংবা ভিসার আবেদন করতে গেলে প্রায়শই কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সত্যায়নের প্রয়োজন হয়। এই সত্যায়নের ক্ষেত্রে অনেকেই “নোটারী” এবং “অ্যাপোস্টিল” শব্দ দুটি শুনে থাকেন, তবে এই দুই প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেকেই স্পষ্টভাবে জানেন না। একটি দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য নোটারী প্রয়োজন, আর আন্তর্জাতিক ব্যবহারের জন্য দরকার অ্যাপোস্টিল। ভুল প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে আপনার আবেদন বাতিল বা স্থগিতও হতে পারে।

তাই এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো—নোটারী এবং অ্যাপোস্টিল কী, কখন কোনটি প্রয়োজন হয় এবং এই দুই প্রক্রিয়ার মূল পার্থক্য কী। সঠিক তথ্য জানলে আপনি সহজেই বুঝে নিতে পারবেন, আপনার ডকুমেন্টের জন্য কোন প্রক্রিয়া জরুরি।

অ্যাপোস্টিল ও নোটারী কী? সংজ্ঞা ও প্রাথমিক ধারণা

অ্যাপোস্টিল কী? – সংজ্ঞা ও প্রাথমিক ধারণা

অ্যাপোস্টিল হলো একটি আন্তর্জাতিক ডকুমেন্ট সত্যায়ন সার্টিফিকেশন, যা হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশগুলোতে বৈধভাবে গ্রহণযোগ্য। এটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ (যেমন: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) দ্বারা ইস্যু করা হয়, এবং এটি প্রমাণ করে যে একটি নোটারীকৃত ডকুমেন্ট আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। অ্যাপোস্টিল সাধারণত বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি, ভিসা বা অভিবাসনের জন্য প্রয়োজন হয়। এটি নোটারীকরণ প্রক্রিয়ার পরে করা হয়, যাতে ডকুমেন্টের স্বীকৃতি বৈশ্বিকভাবে নিশ্চিত হয়।

অ্যাপোস্টিল সম্পর্কে মূল ধারণা:

  • আন্তর্জাতিকভাবে ডকুমেন্ট স্বীকৃতি দেওয়ার একটি পদ্ধতি
  • হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে ব্যবহৃত হয়
  • পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে
  • শিক্ষাগত সনদ, জন্মসনদ, বিবাহসনদ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজন
  • বিদেশি ভিসা, চাকরি, বা উচ্চশিক্ষার আবেদনে বাধ্যতামূলক

নোটারী কী? – সংজ্ঞা ও প্রাথমিক ধারণা

নোটারী হলো একটি আইনি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো ডকুমেন্টের সত্যতা সরকারিভাবে যাচাই করা হয়। এই সত্যায়ন করেন একজন নোটারি পাবলিক, যিনি একজন সরকার অনুমোদিত আইনজীবী। নোটারীকরণ মূলত জাতীয় বা স্থানীয় ব্যবহারযোগ্য ডকুমেন্টের জন্য প্রযোজ্য, যেমন: হলফনামা, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, বা জমির দলিল। এটি সাধারণত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষর যাচাই, তারিখ যাচাই ও ডকুমেন্টের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়।

নোটারী সম্পর্কে মূল ধারণা:

  • সরকার অনুমোদিত নোটারি পাবলিক দ্বারা ডকুমেন্ট সত্যায়ন করা হয়
  • স্থানীয় বা অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহৃত হয়
  • স্বাক্ষর, নাম ও তথ্য যাচাই করে
  • আদালতে ও অন্যান্য সরকারি কাজে ব্যবহারযোগ্য
  • সাধারণত কোনো বিদেশি প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়

অ্যাপোস্টিল ও নোটারী – কোনটা কখন প্রয়োজন হয়?

নোটারী এবং অ্যাপোস্টিল—উভয়ই ডকুমেন্ট সত্যায়নের প্রক্রিয়া হলেও এদের প্রয়োগক্ষেত্র একেবারেই আলাদা। সাধারণভাবে বলা যায়, নোটারী প্রয়োজন হয় অভ্যন্তরীণ বা জাতীয় পর্যায়ে, আর অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক বা বিদেশে ব্যবহারের জন্য।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি বাংলাদেশে কোনো হলফনামা, জমির দলিল, বা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে চান, তাহলে নোটারী যথেষ্ট। কিন্তু আপনি যদি বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি, বা ইমিগ্রেশনের জন্য আপনার জন্মসনদ বা সনদপত্র ব্যবহার করতে চান, তবে অ্যাপোস্টিল বাধ্যতামূলক। সঠিক পরিষেবা না নেওয়ার ফলে অনেক সময় আবেদন বাতিল হতে পারে বা বিলম্ব হয়। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক প্রক্রিয়া বেছে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন হয় যখন:

  • বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষাগত সনদ সত্যায়ন করতে
  • বিদেশে চাকরির জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বা জন্মসনদ পাঠাতে
  • ইমিগ্রেশন বা পারিবারিক পুনর্মিলনের ভিসা আবেদনে
  • বিদেশি আদালতে বা সংস্থায় ডকুমেন্ট ব্যবহার করতে
  • হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে যেকোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট প্রমাণ করতে

নোটারী প্রয়োজন হয় যখন:

  • হলফনামা, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, জমির দলিল ইত্যাদির সত্যতা প্রমাণ করতে
  • বাংলাদেশে আদালতে কাগজ জমা দিতে
  • কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে আইনি চুক্তি করতে
  • ব্যাংক বা সরকারি অফিসে ডকুমেন্ট সত্যায়ন দরকার হলে
  • অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিগত বা পেশাগত কাজে

অ্যাপোস্টিল ও নোটারীর মধ্যে পার্থক্য কী?

অনেকেই মনে করেন নোটারী এবং অ্যাপোস্টিল একই ধরনের ডকুমেন্ট সত্যায়নের প্রক্রিয়া, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের কাজ, উদ্দেশ্য এবং বৈধতা একেবারেই আলাদা। নোটারী একটি অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় আইনগত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন সরকার অনুমোদিত নোটারী পাবলিক নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট যাচাই করে তার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

এটি সাধারণত দেশীয় লেনদেন, জমির দলিল, হলফনামা, বা ব্যাংক সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, অ্যাপোস্টিল হলো একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সার্টিফিকেশন যা হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশগুলোতে ডকুমেন্ট ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয়। এটি সাধারণত শিক্ষাগত সনদ, জন্মসনদ, বিবাহসনদ, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদির জন্য বিদেশে আবেদন করতে গেলে প্রয়োজন হয়।

নোটারীকরণে কেবলমাত্র সেই ডকুমেন্ট সত্যায়িত হয়, যেটি অভ্যন্তরীণভাবে স্বীকৃত হতে হয়। কিন্তু অ্যাপোস্টিল করলে সেই একই ডকুমেন্ট আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়, যেটি বিশেষ করে হেগ চুক্তিভুক্ত দেশের জন্য প্রযোজ্য। আবার নোটারীকৃত ডকুমেন্ট বিদেশে স্বীকৃত হবে না যদি তা অ্যাপোস্টিল না করা হয়। তাই বিদেশে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অ্যাপোস্টিল প্রয়োজনীয়, আর দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নোটারী যথেষ্ট।

নিচের টেবিলটিতে আমরা দুটির মূল পার্থক্যগুলো সহজভাবে উপস্থাপন করেছি:

বিষয়বস্তু

নোটারী (Notary)

অ্যাপোস্টিল (Apostille)

কার্যপ্রক্রিয়া

সরকার অনুমোদিত নোটারী পাবলিক কর্তৃক স্বাক্ষর ও সত্যায়ন

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেট প্রদান করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বৈধতা ক্ষেত্র

দেশীয় বা অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে বৈধ

আন্তর্জাতিক ব্যবহারে (হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে) বৈধ

ডকুমেন্ট ব্যবহার

হলফনামা, জমির দলিল, চুক্তিপত্র ইত্যাদি

শিক্ষাগত সনদ, জন্মসনদ, বিবাহসনদ ইত্যাদি

অনুমোদনকারী সংস্থা

নোটারী পাবলিক

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা তাদের নির্ধারিত সংস্থা

গ্রহণযোগ্যতা

দেশের ভেতরে কার্যকর

বিদেশে গ্রহণযোগ্য (বিশেষ করে হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে)

প্রক্রিয়ার ধাপ

সরাসরি নোটারীর মাধ্যমে

সাধারণত নোটারী করার পর অ্যাপোস্টিল করতে হয়

ব্যবহারকারী লক্ষ্য

স্থানীয় নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান

যারা বিদেশে ভিসা, চাকরি বা পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন

 

অ্যাপোস্টিল ও নোটারীর মূল কাজ ও ব্যবহারের পার্থক্য

অ্যাপোস্টিলের মূল কাজ:

অ্যাপোস্টিল হলো একটি আন্তর্জাতিক সত্যায়ন পদ্ধতি যা হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশগুলিতে নথির বৈধতা নিশ্চিত করে। এটি নোটারিকৃত বা সরকারি কর্তৃপক্ষ দ্বারা সত্যায়িত নথিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করে, বিশেষ করে বিদেশে শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য। অ্যাপোস্টিল মূলত নথির উৎস ও স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করে, কিন্তু নথির বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে না।

অ্যাপোস্টিল যেখানে ব্যবহার হয়:

  • বিদেশে নথির স্বীকৃতি
  • আন্তর্জাতিক নথি প্রমাণীকরণ
  • ভিসা ও শিক্ষার জন্য আবশ্যক
  • সময়সাপেক্ষ ও খরচ বেশি
  • শুধু হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে

নোটারীর মূল কাজ:

নোটারী পাবলিক একজন আইনজীবী বা সরকার অনুমোদিত ব্যক্তি যিনি নথিতে স্বাক্ষরকারীর পরিচয় ও স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করেন। এটি মূলত দেশের অভ্যন্তরে নথির আইনগত বৈধতা প্রদান করে, যেমন চুক্তিপত্র, অ্যাফিডেভিট, দলিল ইত্যাদি সত্যায়ন করা। নোটারির মাধ্যমে নথির বাস্তবতা ও স্বাক্ষরকারীর সত্যতা নিশ্চিত হয়, যা দেশীয় আইনি প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য।

নোটারী যেখানে ব্যবহার হয়:

  • দেশে নথির আইনগত বৈধতা
  • স্বাক্ষর ও দলিল সত্যায়ন
  • চুক্তি ও ঘোষণাপত্র প্রস্তুত
  • দ্রুত প্রক্রিয়া ও কম খরচ
  • ব্যাংক ও জমি সংক্রান্ত কাজ

শেষ কথা

অ্যাপোস্টিল ও নোটারী—দুইটি আলাদা অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলিল সত্যায়নের প্রক্রিয়া, যাদের উদ্দেশ্য এবং প্রভাব ভিন্ন। নোটারীকরণ মূলত দেশের অভ্যন্তরে আইনগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে একজন নোটারী পাবলিক স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করেন।

অন্যদিকে, অ্যাপোস্টিল হলো একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রক্রিয়া, যা বিদেশে নথির গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে, বিশেষ করে হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশগুলোতে। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য বোঝা খুব জরুরি, কারণ ভুল প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে বিদেশি আবেদনপত্র, ভিসা বা শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে বড় জটিলতা তৈরি হতে পারে।

তাই ব্যক্তিগত, শিক্ষা, বা কর্মসংস্থান সংক্রান্ত নথিপত্র যাচাইয়ের আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার—নোটারী যথেষ্ট হবে নাকি অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে আপনি সময়, অর্থ এবং ঝামেলা—সবকিছুই সাশ্রয় করতে পারবেন।

সচরাচর জিজ্ঞাস্য

1 কবে অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন হয়?

যখন আপনি হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে পড়াশোনা, চাকরি বা অভিবাসনের জন্য আবেদন করেন, তখন অ্যাপোস্টিল প্রয়োজন হয়। এটি ডকুমেন্টকে বৈদেশিক কর্তৃপক্ষের কাছে বৈধ করে তোলে।

2 কবে কেবল নোটারী করলেই চলবে?

যদি ডকুমেন্ট শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করা হয়, যেমন ব্যাংকিং, জমির দলিল বা স্থানীয় চুক্তিতে, তাহলে শুধু নোটারী করলেই যথেষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রয়োজন হয় না।

3 নোটারী ও অ্যাপোস্টিল একসাথে করতে হয় কি?

কিছু ক্ষেত্রে অ্যাপোস্টিলের আগে ডকুমেন্ট নোটারীকৃত হতে হয়। তাই আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহারের আগে প্রথমে নোটারী এবং পরে অ্যাপোস্টিল করতে হতে পারে।

4 বিদেশে চাকরির জন্য অ্যাপোস্টিল দরকার কি?

হ্যাঁ, হেগ কনভেনশনভুক্ত দেশে চাকরির আবেদন করতে হলে শিক্ষাগত, অভিজ্ঞতা ও পরিচয়পত্র অ্যাপোস্টিল করা আবশ্যক হয়। এটি কাগজপত্রকে বৈধতা দেয়।